কক্সবাজারে সাড়ে তিন মাসে রেকর্ড ছিনতাই

মুহিবুল্লাহ মুহিব •

পর্যটন নগরী কক্সবাজারে প্রায় প্রতিদিনই ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছিনতাই, ছিনতাইয়ে বাধা দেওয়ায় ছুরিকাঘাত-এমনি হত্যার মতো ঘটনাও ঘটছে।

বিশেষ করে মধ্যরাত ও ভোরের দিকে সবচেয়ে বেশি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে বলে দাবি পুলিশের। আর ছিনতাইকারীদের টার্গেটে থাকেন মধ্যবিত্ত ও নি¤œ মধ্যবিত্তরা।

নতুন বছরের গেল সাড়ে তিন মাসে অতিতের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে ছিনতাইয়ের মামলা। নিয়মিত ছিনতাইয়ের এমন ঘটনায় জেলাজুড়ে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা বাড়ছে।

পুলিশের তথ্যমতে, কক্সবাজার শহরে ২০১৯ সালে ছিনতাইয়ের অভিযোগ রেকর্ড হয়েছে মাত্র ৮টি। ২০২০ সালে প্রায় চার গুণ (২৬২ দশমিক ৫ শতাংশ) বেড়ে ছিনতাইয়ের অভিযোগ দাঁড়ায় ২৯টি। আর ২১ সালের ডিসেম্বরে এসে ছিনতাইয়ের অভিযোগ রেকর্ড হয়েছে ৩৩টি। যা ২০২২ সালে এসে দাড়িয়েছে সাত গুণে। শুধুই নতুন বছরের (২০২২) জানুয়ারী থেকে এপ্রিলের ২০ তারিখ পর্যন্ত ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৪০ টি। আসামী গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৬২ জন। যাদের কাছ থেকে ছিনতাইয়ে ব্যবহৃত অস্ত্র-ছুরি-চাকোও মিলেছে। যা অতিতের বছরগুলোর চেয়ে কয়েকগুন বেশি।

নানা কৌশল অবলম্বন করে জামিনে বেরিয়ে আবারও ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়ছে অনেকে এমনটা জানিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কক্সবাজার আদালতের এক সিনিয়র আইনজীবি দৈনিক কক্সবাজারকে জানান, ছিনতাইয়ের ঘটনাকে ‘হারানোর ঘটনা’ উল্লেখ করে জিডি এর অন্যতম কারণ। এতে অপরাধীরা সামান্য আইনি ব্যবস্থার মধ্যেও আসছে না। অজ্ঞাত আসামি উল্লেখ করে মামলা করায় সাক্ষী পাওয়া যায় না।

এছাড়া মামলার তদন্তে প্রযুক্তির ব্যবহারেও রয়েছে ঘাটতি। এ অবস্থা থেকে বের হতে ছিনতাইয়ের অপরাধগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে তদন্তে কথা বলছেন তিনি। পাশাপাশি ছিনতাইয়ের অপরাধকে ‘ছিনতাই’ নামে মামলা হওয়া উচিত বলে মনে করেন এই আইনজীবি।

কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ফরিদুল আলম বলেন, ছিনতাইকারীদের ব্যবহৃত যে ছুরি-চাকু বহনে কোন আইনি বাঁধা নেই। যার ফলে সহজে জামিন পেয়ে যায়। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে এসব মামলায় জামিনের ক্ষেত্রে আদালতও আরও সতর্ক হয়েছে।
কক্সবাজার নাগরিক আন্দোলনের মূখপাত্র এইচ এম নজরুল ইসলাম বলেন, নানা ক্রটির কারণে ছিনতাই মামলার আসামিরা খালাস পেয়ে যায়। এক্ষেত্রে মামলার তদন্তে মূল সমস্যা হয়। তা না হলে হাতেনাতে ধরা পড়ার পর খালাস পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

অনেক সময় দেখা যায়-দীর্ঘদিন ধরে সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে আসেন না, আবার এলেও তারা সঠিক কথা বলেন না। জব্দ অর্থ ও দ্রব্য নিয়ে তারা ভুল তথ্য দেন। এ জন্য সাক্ষী নির্বাচনের ক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে। অভিযোগ প্রমাণের জন্য যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত থাকতে হবে। এখানে সবচেয়ে ভুমিকা রাখতে হবে পুলিশকে।

আর বিশ্লেষকরা মনে করেন, ছিনতাইয়ের মামলার ক্ষেত্রে বলা যায়-আইনের দুর্বলতা যতটা না, তার চেয়ে বেশি পদ্ধতিগত ও সদিচ্ছার অভাব। এছাড়া পুরো তদন্ত প্রক্রিয়ার মধ্যে বড় ধরনের ঘাটতি আছে। এর বাইরে অপরাধগুলোর ‘ক্লারিফিকেশন’ ও ‘ওয়েল ডিফাইন’ করার ক্ষেত্রেও অনেক ঘাটতি আছে। এজন্য ছিনতাইয়ের অপরাধকে হারানো, ডাকাতি বা দস্যুতা না বলে ‘ছিনতাই’ হিসাবেই উল্লেখ করা উচিত।

এছাড়া এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন ছিনতাইকারী গ্রæপ পরিবহণের ব্যবহার ছাড়াই সম্পদ লুটে নিয়ে সটকে পড়ে। দুইভাবে ছিনতাইয়ের টার্গেট করা হয়। একটি হলো-টাকা লেনদেন হয় এমন এলাকাগুলোয় নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে টার্গেট করে সুবিধাজনক স্থানে মাস্টারপ্ল্যান করে ছিনতাই। অন্যটি হলো-ছিনতাইকারীদের টার্গেট এলাকা দিয়ে চলাচলকারী ব্যক্তির সর্বস্ব লুটে নেওয়া।

কক্সবাজার শহরের বিজিবি ক্যাম্প, রুমালিয়ারছড়া, পশ্চিম লারপাড়া, উত্তরণ পাহাড়, আদর্শ গ্রাম মোড়, লাইট হাউস পাড়ার মুসলিম সড়ক, গোলদীঘির পাড়, কলাতলী বাইপাস, বাজারঘাটা ও মগপাড়া এই ১১ স্পটকে ছিনতাইকারীদের স্পট হিসেবে চিহ্নিত করেছে গোয়েন্দা পুলিশ।

সা¤প্রতিক সময়ে কক্সবাজার জেলাজুড়ে খুন, ছিনতাইম, কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত, যানজট, পাসপোর্ট অফিসে জন ভোগান্তি ও উখিয়া-টেকনাফের ক্যাম্প ছেড়ে রোহিঙ্গাদের পালিয়ে শহরমুখি হওয়ার প্রবণতা নিয়ে জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভায় ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।
কক্সবাজার সদর মডেল থানার ওসি তদন্ত মো. সেলিম উদ্দিন বলেন, আমাদের নথির হিসেবে গেল সাড়ে তিন মাসে ছিনতাইয়ের অভিযোগে মামলা হয়েছে ৪০ টি। আসামী ধরা হয়েছে ৬২ জন। যাদের কাছ থেকে ছুরি-চাকুও উদ্ধার করা হয়। যাদের কাছে এসব অস্ত্র পাওয়া যায় তাদেরকে অস্ত্র মামলা দেয়ারও প্রক্রিয়া রয়েছে।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘শহরের অপরাধ দমনে পুলিশের কয়েকটি বিশেষ টিম কাজ করছে। মাদক পাচার রোধ ও কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাতসহ নানা ধরনের অপরাধ বন্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার বিকল্প নেই।

তিনি বলেন, শহরে চলমান উন্নয়ন কর্মকাÐের কারণে অধিকাংশ সিসিটিভি ক্যামেরা অচল হয়ে পড়েছে। এতে অপরাধীদের চিহ্নিত করতে বেগ পেতে হচ্ছে। তবে শহরের বাজারঘাটা এলাকার ৩-৪টি ক্যামেরা এখনো সচল রয়েছে।